এক্স=প্রেম (২০২২)

     

      ৭/১০

    এক্স=প্রেম সৃজিত মুখার্জির আঠারোতম বাংলা ছবি। অটোগ্রাফ থেকে কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত পরিচালক নানারকম ছবি করেছেন। কিন্তু এই ছবিটি সেগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা। কেন আলাদা সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। 

     এটি একটা সাই-ফাই-রোম্যান্টিক থ্রিলার ঘরানার ছবি। ছবিটি জিম ক্যারি ও কেট উইন্সলেট অভিনীত ইটার্নাল সানসাইন অফ দ্য স্পটলেস মাইন্ড ছবিটি থেকে অনুপ্রাণিত। যেখানে ইটার্নাল সানসাইনের গল্পে মানুষের স্মৃতি মুছে ফেলা যায় এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দেখানো হয়েছে, সেখানে এক্স=প্রেম আরও এক কাঠি উন্নত প্রযুক্তির কথা বলে। গল্পের অন্যতম মূল চরিত্র খিলাত একটি দুর্ঘটনায় তার শেষ দশ বছরের (১৮-২৮ বছর বয়সের) স্মৃতি হারালে একজন ডাক্তার/বিজ্ঞানী তাকে স্মৃতি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেয়। অর্থাত্‍ অন্য একজনের স্মৃতি তার মস্তিষ্ক থেকে বের করে নিয়ে খিলাতের মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করার পরামর্শ দেয়। ছবির গল্প শুরু হয় ঠিক এখান থেকেই। খিলাত প্রশ্ন করে, "ইজ দিস ইল্লিগাল?"  এরপর আস্তে আস্তে আমরা ডাক্তার/বিজ্ঞানীর সাথে খিলাতের কথোপকথনে প্রবেশ করি। ফ্ল্যাশব্যাকে আমাদের দেখানো হয় জয়ী এবং খিলাতের কলেজ প্রেমের সময়। ছবির এই অংশটা দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় পরিচালক তার অতীত অভিজ্ঞতার নস্টালজিয়ায় ভর করে এই দৃশ্যগুলির নির্মাণ করেছেন। তাই কারোর কাছে এই জায়গা গুলি (বিশেষ করে ডাইলগ) ক্লিশে লেগেছে, কারোর আবার মনে হয়েছে ক্লিশে হলেও একটা পর্যায়ে এগুলি সঠিক উপস্থাপন। আমি দ্বিতীয় দলে।

    ছবির প্রথম অর্ধ তুলনামূলক ভাবে দ্বিতীয় অর্ধের থেকে একটু ধীর গতিতে চলে। কিছু দর্শকের তা বোরিং লাগতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমার তা লাগেনি। যাইহোক, দ্বিতীয় অর্ধে অর্জুনের চরিত্র অর্ণবের আগমন ঘটলে ঘটনাপ্রবাহ অন্য মোড় নেয়। আমরা অর্ণবের একতরফা প্রেমের দৃশ্যগুলি দেখতে পাই। এখানে যে জিনিসটা উল্লেখযোগ্য, তা হল এই ছবিটিতে পাঁচটি প্রেম দেখানো হয়েছে। প্রথম, জয়ী ও খিলাতের কলেজ প্রেম। দ্বিতীয়, অর্ণবের জয়ীর প্রতি একতরফা প্রেম। তৃতীয়, অদিতির অর্ণবের প্রতি প্রায় একতরফা প্রেম। এবং শেষমেষ খিলাতের নতুন করে জয়ীর  প্রতি প্রেম এবং জয়ীর স্মৃতি মুছে ফেলার পর অর্ণব আর অদিতির প্রেম। 

    ছবিটির মধ্যে প্রচুর দৃশ্য রয়েছে যা ভাল লাগার মত। যদিও তার অনেকটাই ট্রেইলার এবং আগেই প্রকাশিত হয়ে যাওয়া গানেই আমরা দেখতে পেয়েছি। জঙ্গলের মধ্যে খিলাতের আওরানো কবিতা, অর্ণব ও অদিতির প্রথম যৌন দৃশ্য, লাইট হাউসের ড্রোন শট, প্রথমবার হাসপাতালে জয়ীর প্রতিক্রিয়া, ইত্যাদি। কিন্তু এখানে একটা দৃশ্যের কথা বলতেই হচ্ছে। ছবির একদম শুরুর দিকে খিলাত তার নিজস্ব ভালোবাসা/প্রেমের সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করে। খিলাত বলে "হোয়াট ইজ লাভ বাট মেকিং মেমোরিজ ডেইলি অন দ্য বেসিস অফ মোর মেমোরিজ?" 

এখানে পরিচালক/চিত্রনাট্যকার হয়ত শুধু ভালবাসা বা প্রেম নয়, আমাদের খুব নিজ্স্ব পরিচিতি বা আইডেনটিটিকেই প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। সত্যিই, স্মৃতি ছাড়া আমি কী আদৌ আমি? 


     ছবির গান গুলি প্রত্যেকটি অসাধারণ এবং অনুপমহীনতা একটা তাজা ভাল লাগার অনুভুতি দিয়েছে। ছবিতে মূল চরিত্রগুলিতে প্রত্যেকের অভিনয় সাবলীল। তাদের মধ্যে শ্রুতি দাস এবং অর্জুন চক্রবর্তী আলাদা ভাবে দাগ কেটেছেন। মধুরিমা বসাকের অভিনয়ও মাঝে মাঝে চোখে পড়ার মত। অন্যদিকে, অনিন্দ্যর অভিনয় সাধারণ। অর্থাত্‍ খারাপ বা খুব ভাল কোনটিই নয়। চিত্রগ্রহন ভাল লাগার মত। শুধু পুরো ছবিটিই মনোক্রমে কেন তার কোনও যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। একমাত্র ব্যাখ্যা পরিচালকের ইচ্ছে। 

    এবার আসা যাক ছবিটি কতটা বিচার বা অবিচার করতে পারলো সে বিষয়ে।  ছবিটি থ্রিল দিতে পারেনি মোটেও। দ্বিতীয়ত, ছবিটির থেকে আমার অন্যরকম প্রত্যাশা ছিল। আমার মনে হয়েছিল স্মৃতি হারিয়ে অন্যের স্মৃতি নেওয়ার ব্যাপারটা অনেকটা কাফকাইষ্কই বটে। যেখানে কাফকার গল্পে গ্রেগর সামসার পরিবর্তনটা শারিরীক, সেখানেই খিলাতের পরিবর্তনটা মানসিক। সৃজিত মুখার্জির মত একজন পরিচালক একটা কাফকাইষ্ক গল্পের মোড়কে একটি প্রেমের গল্প বলবেন, এ তো যেকোনো সৃজিত-ভক্তের স্বপ্ন। কিন্তু না, খিলাত হয়ে উঠল না গ্রেগরের সাইকলজিক্যাল প্যারালাল। আবার গল্পের শেষে যে হ্যাপি এন্ডিং হল তার ফলে গল্পটা হয়ে উঠলো না রিয়েলিস্টিক। ছবিটি একটি রূপকথার গল্প হয়ে থেকে গেল যা আপনার সাধারণ ভাবে দেখতে/শুনতে ভাল লাগবে, মনে হবে কলেজবেলার একটা নিষ্পাপ স্পর্শ এর মধ্যে রয়েছে, কিন্তু এটি আপনাকে বৌদ্ধিক কোনও সুখ দেবেনা। এই কারণেই ছবিটি তথাকথিত সৃজিত মুখার্জি ফিল্ম নয়। 


Comments

Popular posts from this blog

টেনেট (২০২০)